বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি হলো সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা (Indus Valley Civilization)। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা আধুনিক পাকিস্তান ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রসারিত ছিল। এর প্রধান নগর কেন্দ্রগুলো ছিল মোহেঞ্জোদারো এবং হারপ্পা। এই দুই মহানগর একসময় উন্নত নগর পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হলো — এই মহাসভ্যতা হঠাৎ করে কেন পতনের মুখে পড়লো?
আজ আমরা বিশ্লেষণ করবো মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার পতনের কারণ নিয়ে আধুনিক গবেষণা ও মতামতসমূহ।
মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পা: একটি সমৃদ্ধ নগরজীবন
-
নগর পরিকল্পনা: গৃহসমূহ নির্দিষ্ট ছকে নির্মিত, পাকা রাস্তা ও উন্নত নালা ব্যবস্থা ছিল।
-
ব্যবসা-বাণিজ্য: মেসোপটেমিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
-
সমাজ ব্যবস্থা: সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো ও পরিশীলিত সামাজিক জীবন বিদ্যমান ছিল।
-
লিপি: আজও অপরিচিত সিন্ধু লিপি (Indus Script) ব্যবহার হতো।
মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার পতনের সম্ভাব্য কারণসমূহ
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disasters)
অনেক গবেষক মনে করেন, মহা বন্যা ও ভূমিকম্পের কারণে মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছিল।
-
বন্যা: সিন্ধু নদী বারবার পথ পরিবর্তন করেছিল, ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জনপদগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল।
-
ভূমিকম্প: নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ভূভাগের অবনতির অন্যতম কারণ হিসেবে ভূমিকম্পকেও দায়ী করা হয়।
২. জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change)
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে খরা দেখা দিয়েছিল।
-
কৃষির উপর নির্ভরশীল এই সভ্যতার জন্য পর্যাপ্ত বর্ষা আবশ্যক ছিল।
-
বর্ষার অনিয়ম ও খরার কারণে খাদ্যসংকট শুরু হয় এবং নগর জীবন দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. নদীর গতিপথ পরিবর্তন (River Course Shift)
সিন্ধু ও ঘগর-হাকরা (বর্তমানে শুকনো নদী) নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে জল সরবরাহ ব্যবস্থায় ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়েছিল।
-
পানির অভাবে কৃষিকাজে বিপর্যয় ঘটে।
-
ফলে শহরবাসীরা ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করে।
৪. বহিরাগত আক্রমণ (External Invasion)
কিছু প্রাচীন তত্ত্ব অনুসারে, আর্য জাতির আক্রমণ এই সভ্যতার পতনের একটি কারণ হতে পারে।
-
রিগবেদে যুদ্ধ ও ধ্বংসের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যদিও এই তত্ত্ব বর্তমানে অনেক গবেষক বিতর্কিত বলে মনে করেন।
-
তবে কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে শহর ধ্বংসের ও অস্থিরতার প্রমাণ মেলে।
৫. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় (Economic and Social Decline)
অতিরিক্ত জনসংখ্যা, বাণিজ্য পথ পরিবর্তন, এবং সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও ধীরে ধীরে সভ্যতার পতনে ভূমিকা রেখেছিল।
-
কারুশিল্পের মান কমে যাওয়ার নিদর্শন পাওয়া গেছে।
-
প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতাও শহর পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করে।
মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার পতনের উপর আধুনিক গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি
-
জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর পরিবর্তন এখন মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার পতনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
-
সামগ্রিকভাবে, এটি একটি ধীর ও ধাপে ধাপে পতন ছিল — হঠাৎ কোনও বড় যুদ্ধ বা বিপর্যয় নয়।
-
সভ্যতার অবকাঠামো টিকে থাকলেও জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ভাঙন ধীরে ধীরে নগর জীবনের অবসান ঘটিয়েছে।
মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পার পতনের শিক্ষা
-
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি নির্ভরশীলতা ও তার পরিবর্তনের প্রতি অবহেলা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে।
-
পানি ও কৃষি ব্যবস্থার টেকসই ব্যবস্থাপনা সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্য অপরিহার্য।
-
সমন্বিত সমাজ কাঠামো বজায় রাখা সভ্যতার স্থায়ীত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উপসংহার
মোহেঞ্জোদারো ও হারপ্পা ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম উন্নত প্রাচীন নগরসভ্যতা।
তবে প্রকৃতি, পরিবেশ পরিবর্তন এবং মানবিক দুর্বলতার সম্মিলিত প্রভাবে এই গৌরবময় অধ্যায় অবসানের দিকে গড়িয়ে যায়।
আজও এই শহরগুলোর ধ্বংসস্তূপ মানবজাতিকে মনে করিয়ে দেয় যে, উন্নতি যত বড়ই হোক না কেন, প্রকৃতি ও সমাজের প্রতি যত্নবান না হলে পতন অবশ্যম্ভাবী।