পৃথিবীর ইতিহাসে মিশরের পিরামিড এক বিস্ময়কর রহস্য। হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে এই বিশালাকার পাথরের স্থাপনাগুলোর দিকে। পিরামিডের নির্মাণপদ্ধতি, উদ্দেশ্য এবং এর পেছনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিয়ে নানা গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। আজ আমরা এই নিবন্ধে পিরামিডের নির্মাণ, মিশর ও সুদানের পিরামিডের পার্থক্য এবং ধর্মীয় উৎসসমূহের আলোকপাত করবো।
মিশরের পিরামিড: ইতিহাস ও নির্মাণ পদ্ধতি
মিশরের প্রাচীন সভ্যতায় পিরামিড নির্মিত হয়েছিল মূলত ফারাওদের (রাজাদের) সমাধি হিসেবে। তারা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পর পুনর্জীবনের জন্য একটি চিরস্থায়ী বিশ্রামস্থল প্রয়োজন। এই জন্যই এত বিশাল ও স্থায়ী কাঠামো নির্মিত হতো।
সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড:
-
খুফুর পিরামিড (Great Pyramid of Giza) — প্রায় ২৫৬০ খ্রিস্টপূর্বে নির্মিত, উচ্চতা ১৪৬.৬ মিটার (বর্তমানে ১৩৮.৮ মিটার)।
-
প্রায় ২৩ লক্ষ পাথরের ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে, প্রতিটির ওজন ২.৫ টন থেকে শুরু।
নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে প্রধান তত্ত্বসমূহ:
১. সরণী বা ঢালু পথ তত্ত্ব
বিশাল মাটির ঢালু র্যাম্প তৈরি করে পাথরগুলো গড়িয়ে বা টেনে ওপরে তোলা হতো।
২. অভ্যন্তরীণ র্যাম্প তত্ত্ব
ফরাসি স্থপতি জ্যঁ-পিয়ের হউদান ধারণা দেন, পিরামিডের ভেতরেই সর্পিলাকার ঢালু পথ তৈরি করে ব্লকগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।
৩. জল ব্যবহার তত্ত্ব
কিছু গবেষক মনে করেন, ব্লকগুলো জলপথ বা কৃত্রিম খালের সাহায্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো।
পিরামিড নির্মাণে কারা কাজ করেছিল?
পুরনো ধারণা ছিল দাসেরা নির্মাণ করেছে, তবে আধুনিক গবেষণা বলছে:
-
মিশরীয় কৃষক জনগণ বর্ষার মৌসুমে নির্মাণে অংশ নিতেন।
-
শ্রমিকরা পারিশ্রমিক, খাদ্য ও চিকিৎসা পেতেন।
-
এটি ছিল ধর্মীয় আনুগত্য ও রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের প্রতীক।
সুদান ও অন্যান্য দেশের পিরামিড
অনেকের অজানা, মিশর ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও পিরামিড নির্মাণের নিদর্শন রয়েছে।
সুদান: কুষান পিরামিড
সুদানে রয়েছে প্রায় ২০০টিরও বেশি পিরামিড।
-
মেরো (Meroë), নাপাটা (Napata) ও কুর্তু (Kurru) এলাকায় অবস্থিত।
-
নির্মিত হয়েছিল কুষ সাম্রাজ্যের শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ – খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী)।
-
তুলনামূলক ছোট, খাড়া ঢালবিশিষ্ট এবং তীক্ষ্ণকোণী আকারের।
অন্যান্য দেশে:
-
মেক্সিকো: মায়া সভ্যতার পিরামিড যেমন চিচেন ইৎজা।
-
চীন: সম্রাটদের সমাধি পিরামিড (উত্তরপূর্ব চীনে)।
-
পেরু: ইনকা সভ্যতার পিরামিড আকৃতির কাঠামো।
মিশর ও সুদানের পিরামিডের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিষয় | মিশরের পিরামিড | সুদানের পিরামিড |
---|---|---|
সময়কাল | খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০-২৪০০ | খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ – খ্রিস্টীয় ৩৫০ |
আকৃতি | বিশাল, প্রশস্ত ঢাল | ছোট, খাড়া ঢাল |
উদ্দেশ্য | ফারাওদের সমাধি | রাজা ও অভিজাতদের সমাধি |
সংখ্যা | প্রায় ১১৮টি | প্রায় ২০০টির বেশি |
ধর্মীয় গ্রন্থে পিরামিড সম্পর্কে ব্যাখ্যা
কুরআনে পিরামিড প্রসঙ্গ
কুরআনে সরাসরি ‘পিরামিড’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তবে ফিরআউন ও তার নির্মিত উঁচু অট্টালিকা সম্পর্কে ইঙ্গিত আছে:
“ফিরআউন বলল, ‘হে হামান! আমার জন্য একটি উঁচু অট্টালিকা নির্মাণ কর, যাতে আমি মুসার ইলাহের কাছে পৌঁছাতে পারি।'”
— (সূরা আল-মু’মিন, আয়াত ৩৬-৩৭)
মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা:
-
ইবনে কাসীরসহ অনেক মুফাসসির মনে করেন, এই অট্টালিকা হতে পারে বিশাল ইমারত বা মন্দিরের প্রতীক, যা সম্ভবত পিরামিডের মত বিশাল কাঠামো।
অন্যত্র বলা হয়েছে:
“আমি কি এই মিসরের অধিপতি নই? আর এই নদীগুলো কি আমার অধীনে প্রবাহিত নয়?”
— (সূরা যুখরুফ, আয়াত ৫১)
এটি ফিরআউনের শক্তি ও সম্পদের অহংকারের ইঙ্গিত দেয়।
বাইবেলে পিরামিড প্রসঙ্গ
বাইবেলেও ‘পিরামিড’ শব্দ ব্যবহার হয়নি, তবে মিশরে ইসরায়েলীয়দের দাসত্বের সময় নির্মাণকাজের উল্লেখ আছে:
“তারা পিথম ও রামসেস নামক মজুদ শহর নির্মাণ করত ফারাওনের জন্য।”
— (যাত্রাপুস্তক, ১:১১)
বিশ্লেষণ:
-
ইসরায়েলীয়রা বড় বড় শহর ও ইমারত নির্মাণে বাধ্য হয়েছিল, পিরামিড নির্মাণের সম্ভাবনার কথা সরাসরি বলা না হলেও নির্মাণ শ্রমের বাস্তবতা ছিল।
উপসংহার
পিরামিড একদিকে প্রাচীন প্রযুক্তির এক অবিশ্বাস্য নিদর্শন, আবার অন্যদিকে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গর্বের প্রতীক।
মিশরের পিরামিড হোক বা সুদানের কুষান পিরামিড — এগুলো প্রমাণ করে যে, মানবজাতি অতীতে নিজস্ব বিশ্বাস, সম্মান ও চিরস্থায়ীত্বের স্বপ্নকে পাথরের আকারে গেঁথে রেখেছিল।
ধর্মীয় গ্রন্থে সরাসরি নাম উল্লেখ না থাকলেও, নির্মাণকাজ ও ফিরআউনের অহংকারের আলোচনায় আমরা এই পিরামিডসমূহের গৌরবের ছায়া দেখতে পাই।
এটি আজও মানব ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় অধ্যায়।