১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশে বিহারীদের অবস্থা: অভিযোগ, বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সাল এক অনন্য, গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তবে এই স্বাধীনতার ইতিহাসের পেছনে রয়েছে কিছু জটিল, বিতর্কিত এবং আজও আলোচিত ঘটনাপ্রবাহ। এর মধ্যে একটি হলো—বিহারী জনগোষ্ঠীর ওপর যুদ্ধ-পরবর্তী সহিংসতা ও সম্পত্তি দখলের অভিযোগ
সম্প্রতি Barrister Fuad–এর একটি আলোচিত টকশোতে এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনা উঠে আসে। এই আর্টিকেলে আমরা তথ্য, প্রেক্ষাপট ও রেফারেন্সের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করবো।


বিহারীরা কারা ছিলেন? – পটভূমি

  • বিহারী বলতে বোঝানো হয় মূলত ভারত থেকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসা উর্দুভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী।
  • তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বেশিরভাগই পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়, যদিও অনেকে নিরপেক্ষ ছিল বা নির্যাতিত হয়।

১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন বিহারী ভূমিকা: দুই মেরু

পক্ষব্যাখ্যা
বিপক্ষ মতামতঅনেক বিহারী রাজাকার, আলবদর, পিস কমিটি ইত্যাদির সাথে জড়িত ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়।
বিকল্প মতামতসব বিহারী এই অপরাধে জড়িত ছিল না। অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে শুধুমাত্র তাদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে।

যুদ্ধ-পরবর্তী সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড – কী ঘটেছিল?

1. আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও রিপোর্ট অনুযায়ী:

“Thousands of Biharis have been slaughtered in Bangladesh in retaliation for their pro-Pakistan role.”
The New York Times, March 29, 1972

“Bihari men, women and children were dragged from their homes and killed after Pakistan’s surrender.”
The Daily Telegraph, 1972

2. Amnesty International (1973) রিপোর্টে উল্লেখ:

  • বিহারীদের উপর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা সংগঠিত হয়েছিল
  • অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে স্থানীয় মানুষজন অংশ নেয়
  • খুলনা, দিনাজপুর, মোহাম্মদপুর (ঢাকা), ও চট্টগ্রামের কিছু ক্যাম্পে গণহত্যার অভিযোগ

3. সুনির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ:

  • খুলনা বয়েজ হোস্টেল গণহত্যা (ডিসেম্বর ১৯৭১): ৩০০+ বিহারী নিহত
  • চট্টগ্রাম Halishahar ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড: পাকিস্তানপন্থীদের শনাক্ত করে গণহারে হত্যা
  • মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের হামলা: কংক্রিট মেশিনে ফেলে হত্যার অভিযোগ (সূত্র: ব্যক্তিগত স্বাক্ষ্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত)

জমি ও সম্পত্তি দখলের অভিযোগ

  • যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অনেক বিহারীর ফেলে যাওয়া বাড়ি, দোকান ও জমি দখল হয়ে যায়
  • কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও অসাধু মুক্তিযোদ্ধা (আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের) এসব সম্পত্তি দখলে নেয়
  • তবে সরকারিভাবে বা দলীয় সিদ্ধান্তে সংগঠিতভাবে এই কাজ হয়েছে—এমন প্রমাণ নেই

Barrister Fuad–এর আলোচনার সারাংশ

Barrister Fuad, একটি টকশোতে বলেন:

“১৯৭১-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় নীরবতায় কিছু বিহারী সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, নির্যাতন এবং জমি দখল হয়—যার দায় ঐ সময়কার ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব এড়াতে পারে না।”

তিনি এও বলেন, এই বিষয়ে সঠিক ঐতিহাসিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও বিচার হওয়া উচিত।


বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ও আদালতের রায়

  • ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বিহারীদের ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়
  • ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়ঃ

“Those born in Bangladesh after 1971 are Bangladeshi citizens.”

  • ২০১৪ সাল থেকে কিছু বিহারী ভোটাধিকারসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন
  • এখনো দেশের কিছু অঞ্চলে বিহারী ক্যাম্প রয়েছে (যেমন: মোহাম্মদপুর, মিরপুর, টঙ্গী)

তথ্যসূত্র (References):

  1. The New York Times, March 29, 1972 – “Biharis Slaughtered in Bangladesh”
  2. Amnesty International Annual Report, 1973 – “Post-War Retaliation Against Non-Bengalis”
  3. Daily Telegraph, UK – 1972 Reports
  4. “Dead Reckoning” by Sarmila Bose – Princeton University Press
  5. Partha Ghosh – “The Biharis: The Stranded Pakistanis”
  6. Bangladesh Supreme Court Ruling – 2008 Citizenship Case
  7. Barrister Fuad Talkshow Interview, YouTube/Online Reference (April 2025)

ইতিহাসের এই অধ্যায় খুবই সংবেদনশীল। বিহারীরা কি অপরাধ করেছিল? হয়তো কিছুজন করেছিল।
কিন্তু তাতে কি গোটা একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিধন, দমন ও বঞ্চিত করা ন্যায্য ছিল?
এই প্রশ্ন ইতিহাস, মানবতা ও রাষ্ট্রের বিবেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এই আলোচনা কোনো রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়ার জন্য নয়, বরং সত্যের সন্ধানে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *