শাসনব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর প্রাণ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসরণ করেছে, তবে মাঝেমধ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের শাসনও অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে:
বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থাই কি আমাদের জন্য সর্বোত্তম, নাকি প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থার মতো বিকল্প চিন্তা করা উচিত?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে উভয় ব্যবস্থার প্রকৃতি, বাস্তব চিত্র এবং সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতি: কাঠামো ও কার্যকারিতা
সংজ্ঞা: প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান (President) একইসাথে সরকারের প্রধান, যিনি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
মূল বৈশিষ্ট্য:
-
স্বাধীন নির্বাহী শাখা: সংসদের চেয়ে আলাদা ক্ষমতা।
-
নির্দিষ্ট মেয়াদ: সাধারণত ৪ বা ৫ বছরের জন্য স্থায়ী মেয়াদ।
-
জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট: প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের নিকট দায়বদ্ধ।
-
দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধা: জরুরি পরিস্থিতিতে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন।
উদাহরণ: যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া।
সংসদীয় পদ্ধতি: কাঠামো ও কার্যকারিতা
সংজ্ঞা: সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারপ্রধান (Prime Minister) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দ্বারা মনোনীত হন এবং সরকারের নীতিনির্ধারণে সংসদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন।
মূল বৈশিষ্ট্য:
-
সরকার ও সংসদের সমন্বয়: নীতি প্রণয়নে সংসদের ভূমিকা সরাসরি।
-
আস্থা ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব: সরকার কার্যক্ষমতা হারালে নতুন নির্বাচন বা সরকার গঠন।
-
দলীয় রাজনীতির প্রাধান্য: সংসদের অধিকাংশই দলীয় আনুগত্যের মাধ্যমে চলে।
-
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সুযোগ: সরকার নিয়মিত সংসদে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
উদাহরণ: ভারত, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমস্যাগুলো কোথায়?
বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির চ্যালেঞ্জসমূহ:
-
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থার সংকট।
-
একক দলের শাসনে সংসদ কার্যত বিতর্কহীন rubber-stamp পরিণত হয়।
-
বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকার অভাব।
-
দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন।
বাংলাদেশে প্রেসিডেন্সিয়াল অভিজ্ঞতার চ্যালেঞ্জসমূহ (অতীতে):
-
একনায়কত্বের দিকে ঝোঁক (বিশেষ করে সামরিক প্রেসিডেন্টদের আমলে)।
-
বিরোধী কণ্ঠ দমন ও গণতান্ত্রিক অবকাঠামো দুর্বলতা।
-
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের প্রবণতা।
সম্ভাব্য লাভ ও ঝুঁকি: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিষয় | প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতি | সংসদীয় পদ্ধতি |
---|---|---|
স্থায়িত্ব | বেশি (নির্দিষ্ট মেয়াদ) | কম (অনাস্থা ভোটে পতন হতে পারে) |
ক্ষমতার ভারসাম্য | যদি সুসংবদ্ধ আদালত ও সংসদ থাকে, ভারসাম্য হয় | সংসদ ও সরকার এক হয়ে গেলে ভারসাম্য দুর্বল হয় |
সিদ্ধান্তগ্রহণ | দ্রুত | বিলম্বিত |
জনগণের অংশগ্রহণ | প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ম্যান্ডেট পায় | জনগণ দল নির্বাচনের মাধ্যমে ভাবে প্রভাব ফেলে |
ঝুঁকি | স্বৈরাচারী প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে | দলীয় একচ্ছত্র আধিপত্য এবং দুর্নীতি |
নিরপেক্ষ নাগরিকের ভাবনা: কীভাবে ভাবতে পারি?
১. শুধু কাঠামো নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধতা জরুরি।
প্রেসিডেন্সিয়াল বা সংসদীয়, যাই হোক— যদি নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম স্বাধীন না থাকে, তাহলে কোন ব্যবস্থাই কার্যকর হবে না।
-
চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করা চাই।
প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী — দুজনের জন্যই শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জরুরি যাতে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে। -
জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার।
সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করলেও যদি জনগণ অনাগ্রহী হয় বা কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। -
বহুস্তরীয় সংস্কার জরুরি।
প্রশাসনিক সংস্কার, দলীয় শাসন সংস্কার, এবং রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ছাড়া কেবল সরকার ব্যবস্থা বদলে উন্নয়ন আসবে না।
উপসংহার
সরকারি কাঠামো বদল কোনও ম্যাজিক নয়।
যদি জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠে, তাহলে প্রেসিডেনশিয়াল হোক বা সংসদীয় — উভয় ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র দুর্বল থেকে যাবে।
তবে বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রেসিডেনশিয়াল মডেল নিয়ে বিতর্ক এবং গভীর চিন্তাভাবনার সময় এসেছে — বিশেষ করে যদি সেটি সুদৃঢ় চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে চিন্তাশীল নাগরিকদের নিরপেক্ষ ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনা অপরিহার্য।
রেফারেন্স:
-
Arend Lijphart, Patterns of Democracy, 1999
-
Montesquieu, The Spirit of the Laws, 1748
-
United Nations Democracy Fund Reports
-
Economist Intelligence Unit, Democracy Index 2024