টাখনুর নিচে কাপড় পরা: ইসলামিক শরিয়ত, বিজ্ঞান ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে পোশাকের প্রতিও রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। কিন্তু কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
তার মধ্যে একটি হলো: “পুরুষদের জন্য টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা কি গুনাহ?”
অনেকে বলেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, আবার অনেকে একে সরাসরি হারাম বলে ফেলেন।
তাহলে এর প্রকৃত হুকুম কী? কেন রাসূল (সা.) এ বিষয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন?
এই আর্টিকেলে আমরা বিষয়টি কুরআন, হাদিস, ফিকহ, বিজ্ঞান ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করব।


কুরআনের দৃষ্টিতে টাখনুর নিচে কাপড় পরা

কুরআনে সরাসরি টাখনু সম্পর্কিত কোনো আয়াত নেই, তবে রয়েছে অহংকারবিরোধী আদেশ:

وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا
“পৃথিবীতে অহংকারভরে চলো না।”
(সূরা লুকমান: ১৮)

কুরআনের এই আয়াত আমাদের শেখায় বিনয় ও নম্রতা। ইসলামে অহংকার সবচেয়ে ঘৃণিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
টাখনুর নিচে কাপড় পরা যদি অহংকারের প্রতীক হয়, তবে তা ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী হয়ে যায়।


হাদিসের আলোকে বিষয়টির বিশ্লেষণ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদিসে এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন:

“যে ব্যক্তি অহংকার করে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।”
(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৭৮৪)

“ইযারের যে অংশ টাখনুর নিচে থাকবে, তা আগুনে জ্বলবে।”
(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৫৭৮৭)

এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, মূল সমস্যাটি অহংকার
সে যুগে অভিজাত শ্রেণি লম্বা পোশাক পরে মাটিতে টানত, যা ছিল ‘status symbol’।
রাসূল (সা.) এমন অহংকারী প্রকাশকে নিন্দা করেছেন এবং নিষিদ্ধ করেছেন।


ফিকহ ও আলেমদের মতামত

আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে:

  • অনেক আলেম বলেন: “যদি অহংকার না থাকে, তবে টাখনুর নিচে কাপড় পরা হারাম নয়, তবে মাকরুহ।”
  • আবার কেউ কেউ বলেন: “রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন — সেটা যথেষ্ট। আমাদের উচিত তা পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা।”

হানাফি ও শাফেয়ি মাযহাবে এই বিষয়ে কিছুটা নমনীয়তা থাকলেও হাম্বলি মাযহাবে এটি অধিক কঠোরভাবে বিবেচিত।


বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ

✅ স্বাস্থ্যগত দিক:

  • নিচে ঝুলে থাকা কাপড় ময়লা পানি, কাদা, জীবাণু ইত্যাদির সংস্পর্শে আসে।
  • হাঁটার সময় পা আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
  • গরম ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

✅ মনস্তত্ত্ব:

  • পোশাক মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম।
  • যেসব ব্যক্তি অহংকারে ভোগেন, তারা অনেক সময় তাদের বাহ্যিক পোশাক দিয়ে তা প্রকাশ করেন।

আধুনিক বাস্তবতা ও ইসলামিক ভারসাম্য

আজকের দিনে প্যান্ট ও মোজা ব্যবহৃত হয় নিয়মিত।
অনেকে বলেন, টাখনুর উপরে কাপড় পরে আবার মোজা পরলে তো টাখনু ঢেকে গেল!
এটি একটি বাস্তবিক প্রশ্ন।

উত্তর হচ্ছে:

  • প্যান্ট বা কাপড় ফ্যাশনের অংশ, তাই তা ঝুলিয়ে অহংকার করা গুনাহ।
  • কিন্তু মোজা বা জুতা পরা রক্ষা ও প্রয়োজনের জন্য — তা হাদিসে নিষেধ নয়।

অতএব, কাপড় টাখনুর উপরে রাখা সুন্নাহ; মোজা পরা জায়েয।


সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ

আমাদের উচিত এমন বিষয়গুলোকে হালকা না দেখে, রাসূল (সা.) এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
অহংকার নয়, আনুগত্যই মুসলিমের পরিচয়।


শেষকথা

ইসলাম অহংকারকে ঘৃণা করে, আর বিনয়কে ভালোবাসে।
যে ব্যক্তি তার পোশাকে বিনয় দেখায়, সে নিজের ভিতরের চরিত্রকে শুদ্ধ রাখে।
টাখনুর উপরে কাপড় পরা ছোট বিষয় মনে হলেও, তা আমাদের বড় গুণ — আনুগত্য ও বিনয়ের চর্চা

“আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়।”
(সূরা আলে-ইমরান: ১৩২)

2 thoughts on “টাখনুর নিচে কাপড় পরা: ইসলামিক শরিয়ত, বিজ্ঞান ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ”

    1. আসলে ভাই, এটা সত্যিই খুব সাধারণ একটা বাস্তবতা — আমরা অনেক সময় মুখে বলে ফেলি, কিন্তু হৃদয়ে মানতে একটু কষ্ট হয়। হয়তো এটা আমাদের প্রবৃত্তির এক রকম প্রতিক্রিয়া। তবে যদি কোনো বিষয় কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এবং তা অহংকার মুক্ত জীবনের দিকে আহ্বান করে — তাহলে একে সহজ করে মেনে নেওয়া মানে নিজেকে আল্লাহর নিকট আরেক ধাপ নিচু করা, যা আমাদের জন্যই নিরাপদ।

      মেনে নেওয়ার চেয়ে বড় সাধনা আর কিছু নেই, আর আত্মমর্যাদার আসল প্রকাশও সেখানেই।
      আল্লাহ যেন আমাদেরকে সকল বিষয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে নেওয়ার মতো বিনয়ী বানান – আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *