১১টি সংস্কার কমিশন – সমাধানের পথ, নাকি আরেকটি প্রতিশ্রুতির খেলা?
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, দেশের প্রশাসনিক, বিচারিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়। কারও কাছে এটি আশা, আবার কারও কাছে এটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—এই কমিশনগুলো আসলে কতটা কার্যকর হবে?
এই প্রবন্ধে আমরা জানব:
-
সংস্কার কমিশন কী?
-
২০২৪–২৫ সালে গঠিত মোট কয়টি কমিশন?
-
প্রতিটির নাম ও দায়িত্ব
-
সংবিধান অনুযায়ী এর বৈধতা
-
অতীত ও আন্তর্জাতিক উদাহরণ
-
এবং জনগণের জন্য এর অর্থ কী
সংস্কার কমিশন কী?
সংস্কার কমিশন হলো একটি অস্থায়ী, স্বাধীন ও লক্ষ্যভিত্তিক সংস্থা, যেটি সরকারের নির্দেশে নির্দিষ্ট একটি খাত বা সমস্যার কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে তার জন্য উপযুক্ত সুপারিশ প্রদান করে।
এই কমিশনগুলো আইন প্রণয়ন করে না, তবে এদের পরামর্শ ও প্রতিবেদন সরকার আইন প্রণয়নে ব্যবহার করতে পারে।
কমিশনের সদস্যরা সাধারণত থাকেন:
-
সাবেক বিচারপতি
-
সাবেক সচিব বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা
-
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক বা গবেষক
-
সুশীল সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধিরা
বর্তমান সরকারের অধীনে গঠিত সংস্কার কমিশনের তালিকা
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে প্রথম ৬টি কমিশন গঠিত হয় অক্টোবরে, এবং পরবর্তী ৫টি নভেম্বরে।
১১টি সংস্কার কমিশনের নাম ও দায়িত্ব:
-
সংবিধান সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: অধ্যাপক আলী রীয়াজ
কাজ: সংবিধানের বিতর্কিত ধারা, ক্ষমতার ভারসাম্য, সংসদীয় কাঠামো বিশ্লেষণ -
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: বদিউল আলম মজুমদার
কাজ: সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রস্তাবনা -
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান
কাজ: বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, বিচারক নিয়োগ ও স্বাধীনতা -
পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: সফর রাজ হোসেন
কাজ: পুলিশি নিরপেক্ষতা, জনবান্ধব আচরণ ও জবাবদিহিতা -
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: ড. ইফতেখারুজ্জামান
কাজ: দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদকের কাঠামোগত সংস্কার -
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
নেতৃত্বে: আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী
কাজ: সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ, পদোন্নতি ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রস্তাবনা -
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
কাজ: ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের ক্ষমতা ও বিকেন্দ্রীকরণ -
শ্রমখাত সংস্কার কমিশন
কাজ: শ্রমিক অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতা -
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন
কাজ: নারী নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও আইনগত সুরক্ষা -
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
কাজ: সাংবাদিক সুরক্ষা আইন, তথ্য অধিকার, ফ্যাক্ট-চেকিং নীতি -
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন
কাজ: সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য বাজেট ও ওষুধ নীতি
সংবিধান অনুযায়ী কমিশন গঠনের বৈধতা
বাংলাদেশ সংবিধানে “সংস্কার কমিশন” শব্দ নেই। তবে সরকার প্রশাসনিক আদেশ, গেজেট অথবা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে যেকোনো সময় কমিশন গঠন করতে পারে।
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন সংশোধন বা সংবিধান সংস্কারে কমিশনের সুপারিশ ব্যবহারযোগ্য।
বাংলাদেশের অতীত সংস্কার কমিশনের নজির
-
১৯৯১: বিচারপতি শাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
-
২০০৭: সেনা-সমর্থিত সরকারের অধীনে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, দুর্নীতিবিরোধী আইন সংস্কার
-
PRP (Police Reform Project) – সুপারিশের বড় অংশ অকার্যকর থেকে যায়
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
দেশ | কমিশন | লক্ষ্য |
---|---|---|
দক্ষিণ আফ্রিকা | Truth & Reconciliation Commission | জাতীয় ক্ষত সারিয়ে তোলা |
ভারত | Administrative Reforms Commission (ARC) | প্রশাসনিক দক্ষতা ও জবাবদিহি |
যুক্তরাজ্য | Law Reform Commission | পুরনো আইন পর্যালোচনা ও সংশোধন |
সমালোচনা ও বাস্তবতা
-
অনেক কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশই করা হয় না
-
কিছু কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়
-
জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কমিশন গণআস্থার প্রতিফলন নয়
-
বাস্তবায়ন না হলে কমিশনের অস্তিত্ব প্রতিশ্রুতির কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে
উপসংহার
সংস্কার কমিশন গঠন একটি ভালো পদক্ষেপ, তবে তা বাস্তবায়নযোগ্য না হলে এর কার্যকারিতা শূন্য।
এই কমিশনগুলো যেন হয়—
-
স্বচ্ছ
-
স্বাধীন
-
জনসম্পৃক্ত
-
এবং কার্যকর
সেই প্রত্যাশায় জনতার পক্ষ থেকে প্রশ্ন থাকবেই—
“সংস্কার কমিশন মানেই কি বদল, নাকি আরেকটি প্রতিশ্রুতির কাগজ?”
আপনার মতামত জানান:
আপনি কি বিশ্বাস করেন এই কমিশনগুলো দেশের বাস্তব পরিবর্তন আনবে? নিচে কমেন্ট করুন।
পরবর্তী বিষয়: কমিশনের রিপোর্ট কীভাবে বাস্তবায়ন হয়? কেন কিছু বাস্তবায়িত হয় না?